বীরশ্রেষ্ঠ হলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা, যা দেশের জন্য আত্মত্যাগ করা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রদান করা হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও ত্যাগের জন্য সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ সম্মাননা দেয়া হয় । তার হলো :-
- সিপাহী মোস্তফা কামাল
- ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ
- ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান
- ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ
- সিপাহী হামিদুর রহমান
- স্কোয়াড্রন লিডার রুহুল আমিন
- ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

আসুন আমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সাত সন্তান তথা সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের পরিচিতি সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নিই।
সিপাহী মোস্তফা কামাল
জন্য : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ সালে।
জনাস্থান: ভোলা জেলার পশ্চিম হাজিপুর থানার দৌলত গ্রামে।
পিতার নাম : হাবিবুর রহমান মণ্ডল।
মাতার নাম: মোসাম্মৎ মালেকা বেগম।
কর্মস্থল : সেনাবাহিনী।
পদবী : সিপাহী।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর: ৮নং সেক্টর।
মৃত্যু :৪৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে।
কবর/সমাধিস্থল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে।
যেভাবে শহীদ হন : ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযান প্রতিহত করতে গিয়ে শহীদ হন।
ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ
জন্ম : ১ মে, ১৯৪৩ সালে।
জন্মস্থান: ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার সালামতপুর গ্রামে।
পিতার নামঃ মুন্সী মেহেদী হোসেন।।
মাতার নাম: মোসাম্মাৎ মুকিতুন্নেছা।
কর্মস্থল: ই.পি.আর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)
ই.পি.আর এ যোগদান: ৮ মে, ১৯৬৩ সালে।
পদবি : ল্যান্স নায়েক।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর: ১নং সেক্টর।
মৃত্যু: ২০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে।
কবর/সমাধিস্থল: চট্টগ্রামের কালুরঘাটের চিংড়ীখালী নদীর তীরে।
যেভাবে শহীদ হন : ২০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে রাঙামাটি ও মহালছড়ির সংযোগপথ নানিয়াচর থানার বুড়িঘাট এলাকায় চিংড়ি খালের দুই পাশে নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যূহ অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং পলায়নরত হানাদার বাহিনীর গুলিতে শাহাদাৎবরণ করেন।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান
জন্ম: ২৯ অক্টোবর, ১৯৪১ সালে।
জন্মস্থান: নরসিংদী জেলার
রায়পুরা থানার বামনগর গ্রামে।
পিতার নাম : আবদুস সামাদ।
কর্মস্থল: বিমান বাহিনী।
বিমান বাহিনীতে যোগদান : ১৯৬৩ সালে।
পদবী: লেফটেন্যান্ট।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর: তিনি পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন।
মৃত্যু: ২০ আগস্ট, ১৯৭১ সালে।
কবর/সমাধিস্থল: পাকিস্তানের করাচির
মৌরিপুর মাশরুর খাঁটিতে ছিল বর্তমানে বাংলাদেশে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
২৪ জুন, ২০০৬ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কবর (মৃতদেহ) বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং ২৫ জুন, ২০০৬ সালে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
যেভাবে শহীদ হন: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর নিজ দেশে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিমান সমর্থন দেবার চিন্তা করতে থাকেন। সুযোগ বুঝে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর মাশরুর ঘাঁটি থেকে ১টি- টি-৩৩ জঙ্গী বিমান ছিনিয়ে নেন এবং বাংলাদেশের পথে রওয়ানা দেন। কিন্তু সিন্ধু প্রদেশের মরু অঞ্চলে। বিমানটি বিধ্বস্ত হলে তিনি শহীদ হন।
ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ
জন্ম: ২৬ এপ্রিল, ১৯৩৬ সালে।
জন্মস্থান: নড়াইল জেলার
মহেষখোলা গ্রামে।
পিতার নামঃ মোঃ আমানত শেখ।
মাতার নাম: মোসাম্মাৎ
জেন্নতা খানম।
কর্মস্থল: ই.পি.আর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্)।
ই.পি.আর এ যোগদান : ১৯৫৯ সালে।
পদবি: ল্যান্সনায়েক।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর: ৮নং সেক্টর।
মৃত্যু: ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে।
কবর/সমাধিস্থল: যশোরের গোয়ালহাটি নামক স্থানে।
যেভাবে শহীদ হন : ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৮ নম্বর সেক্টরে স্থায়ী টহলে নিয়োজিত থাকার সময় পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে পড়েন। সঙ্গীদের বাঁচাতে গিয়ে সম্পূর্ণ একাকী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সঙ্গীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
সিপাহী হামিদুর রহমান
জন্ম: ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩ সালে।
জন্মস্থান: ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার খোরদা খালিশপুর গ্রামে।
পিতার নাম: আক্কাস আলী মণ্ডল।
মাতার নাম: কায়দাছুন্নেসা।
কর্মস্থল: সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীতে যোগদান: ১৯৭০ সালে।
পদবি: সিপাহী।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর: ৪নং সেক্টর।
মৃত্যু: ২৮ অক্টোবর, ১৯৭১ সালে।
কবর/সমাধিস্থল: ভারতের আমবাসা নামক স্থানে ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্তানে। ১১ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রাহমানকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
যেভাবে শহীদ হন : ১৯৭০ সালের ২অক্টোবর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধ আরম্ভ হলে একদিনের জন্য তিনি মায়ের সাথে দেখা করতে আসেন। ফিরে গিয়ে তিনি ৪নং সেক্টরে মৌলভীবাজারস্থ কমলগঞ্জের ধলইতে যুদ্ধ করেন এবং পাকহানাদার বাহিনীর সাথে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাৎবরণ করেন।
স্কোয়াড্রন লিডার রুহুল আমিন
জন্ম: ১৯৩৪ সালে।
জন্মস্থান: নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাগপাদুরা গ্রামে।
পিতার নামঃ মোঃ আজহার পাটোয়ারি।
মাতার নাম: মোছাঃ জুলেখা খাতুন।
কর্মস্থল: নৌবাহিনী।
পদবি :স্কোয়াডন ইঞ্জিনিয়ার।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর:১০নং সেক্টর।
মৃত্যু :১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল।
কবর/সমাধিস্থল: তাঁর পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁকে তুলে খুলনার রূপসা নদীর তীরে কবর দেয়া হয়।
আরো পড়ুন ;মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য তালিকা ও পরিচিতি
যেভাবে শহীদ হন: মুক্তিযুদ্ধে নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস পদ্মার স্কোয়াডন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ১০ ডিসেম্বর, ৭১ হানাদার বাহিনী বিমান হামলা জাহাজের ইঞ্জিনে আগুন লেগে পুড়ে মারা যান।
ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
জন্ম: ১৯৪৯ সালে।
জন্মস্থান: বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে।
পিতার নাম : আবদুল মোতালেব হাওলাদার।
মাতার নাম: মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম।
সেনাবাহিনীতে যোগদান : ১৯৬৭ সালে।
কর্মস্থল: সেনাবাহিনী।
পদবী: ক্যাপ্টেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর: ৭নং সেক্টর।
কবর/সমাধিস্থল : চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে।
মৃত্যু: ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে।
আরো পড়ুনঃ ২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য
যেভাবে শহীদ হন : ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। পাকবাহিনী বেগতিক দেখে পশ্চাৎপদ করে এবং মুক্তিবাহিনী পলায়নরত পাক-বাহিনীকে, ধাওয়া করে। সে সময় পাকবাহিনীর একটি বুলেট কপালে বিদ্ধ হলে তখন তিনি শহীদ হন
উপসংহার; সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের নাম এবং সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের পরিচিতি পোস্টটিতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সাত সন্তানের বিত্তান্ত তূলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি জানি তাদের অবদান ভুলভাল মতো নয়। তাদের নাম বাঙালি হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ধন্যবাদ সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের পরিচিতি পোস্টটিতে মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য।
1 thought on “সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের পরিচিতি”